তৃতীয় প্রজন্মের রাজাকার উৎপাদনের শীর্ষে বাংলাদেশ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ছবিতে দেখা গেল, এক বয়োজ্যেষ্ঠ সুদী মহাজন রাজমুকুট পরে ট্যাবলেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন; পর্দায় লেখা “Razakar Index”—যেখানে বাংলাদেশকে শীর্ষে, পাকিস্তানকে দ্বিতীয় এবং তুরকিকে তৃতীয় দেখানো হয়েছে। প্রথম দেখায় মিম—কিন্তু প্রতিক্রিয়া ছিল সিরিয়াস। অনেকেই লিখেছেন, “জুলাই ২০২৪-এর দাঙ্গা-অস্থিরতার পর ‘রাজাকার’ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে; এখন নাকি আন্তর্জাতিক সূচকেও উঠে এসেছে।” প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি কোনো আন্তর্জাতিক সূচক আছে? নাকি আমরা এমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যখন ব্যঙ্গই হয়ে উঠছে জনমতের প্রধান চালিকা? যা দেখাল পোস্টটি, আর যা দেখা গেল প্রতিক্রিয়ায় ছবিটি স্পষ্টত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো “Razakar Index” বিদ্যমান নেই।

বিশ্বজুড়ে নানা সূচক যেমন দুর্নীতি ধারণা সূচক বা গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচক আছে; কিন্তু ‘রাজাকার’ পরিমাপের কোনো স্বীকৃত গবেষণা, পদ্ধতি বা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। তবু পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হওয়ায় বোঝা যায়, শব্দটি আমাদের রাজনীতি ও জনআলোচনায় কতটা শক্তিশালী প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কেউ হাসলেন, কেউ ক্ষুব্ধ হলেন, আর কেউ লিখলেন—“এমন সূচক না থাকলেও বাস্তবে সংখ্যা নাকি বাড়ছেই!” জুলাই দাঙ্গা-পরবর্তী উত্তাপে ‘রাজাকার’ কেন আবার ফিরে এল ২০২৪ সালের জুলাইয়ের সহিংসতার পর দেশজুড়ে যে তিক্ত বিভাজন তৈরি হয়েছে, তার ভাষা হয়ে উঠেছে ‘রাজাকার’ তকমা জা আসলেই সত্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, লাইভ ভিডিও, টক শো—সবখানেই স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষর আঘাতের সবচেয়ে সহজ শব্দ যেন এটাই “বাংলাদেশ এর জন্মই আজন্মের ভুল” । ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলছিলেন, “আগে রাজাকার বললে ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট দালালচক্র বোঝাতাম এখন আসল রাজাকার সামনেই ।” পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বললেন, “স্বাধীনতা নিয়ে মত দিলেই কেউ না কেউ ‘ভারত এর দালাল’ বলে গালি দেয় এতে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়, সমাধানের পথ আর থাকে না।” এমন প্রতিক্রিয়াগুলো ইঙ্গিত করে—স্বাধীনতা বিরোধীদের এই প্রবণতা সত্যিই জ্যামিতিক হারে বেড়েছে, যদিও ‘সংখ্যা’ দিয়ে এর মাপকাঠি নেই।

ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের মাজাঘেঁষা সংঘাত ভাইরাল পোস্টের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে আরেকটি বিতর্ক—কিছু সাক্ষাৎকার আর ভিডিওতে কয়েকজন দাবি করছেন, ১৯৭১-এর স্বাধীনতার যুদ্ধ নাকি ছিল “ভারতের স্বার্থে”। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের বৃহৎ অংশ এ বক্তব্যকে তথ্যমুক্ত ও অপমানজনক বলে মনে করেন। তাঁদের যুক্তি, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সংগঠিত গণহত্যা—এসবের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র সংগ্রাম, সেটিই মুক্তিযুদ্ধ। ভারতসহ নানা দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা ছিল, কিন্তু যুদ্ধের নৈতিক-রাজনৈতিক কেন্দ্রে ছিল বাঙালির মুক্তির দাবি। তাই “ভারতের স্বার্থে যুদ্ধ হয়েছিল”—এমন বক্তব্যকে অনেকেই ‘স্বাধীনতা পরিপন্থী বয়ান’-এর রূপান্তর বলে দেখেন।

অন্যদিকে, যারা এ কথা বলছেন, তারা বলেন আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে অস্বীকার করা যাবে না। এই দুই অবস্থানই বারুদের মতো; সামাজিক মাধ্যমে সংঘাতকে আরও উসকে দেয়। ব্যঙ্গের শক্তি আর বিপদ ব্যঙ্গ সমাজকে আয়না দেখায়—কিন্তু যখন ব্যঙ্গকে তথ্য হিসেবে ভোক্তা গ্রহণ করে, তখন তা বিভ্রান্তি বাড়ায়। এই ‘রাজাকার সূচক’– প্রমাণ করে, আমাদের কত সহজে স্বাধীনতা বিরোধীরা জুলাই দাঙ্গা ব্র্যান্ডিংয়ের অস্ত্র হয়ে উঠছে। বিশেষ করে তরুণদের একটি অংশ মনে করছে, স্বাধীনতা বিরোধীরাই এখন ক্ষমতায়; ফলে সংলাপের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। এ জায়গায় মিডিয়া লিটারেসি জরুরি—ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, মতামত, আর তথ্যনির্ভর রিপোর্টয়ের পার্থক্য চিনতে না পারলে কোনো “রাজাকার সূচক”ই সত্যি।

একই সঙ্গে, ইতিহাস-সচেতনতা না থাকলে “তৃতীয় প্রজন্মের রাজাকার”—জাতীয় নতুন ভাষা সহজেই সমাজে জায়গা করে নেবে, যা আসলে স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য আতঙ্ক এবং ভারতবিরোধী বয়ানকে পুঁজি করে রাজনৈতিক লাভ আদায়ের কৌশলের অভিপ্রায়।


মানুষ কী ভাবছে রাজধানীর বাইরে থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। চট্টগ্রামের এক নারী উদ্যোক্তা লিখেছেন, “রাজাকার শব্দটা শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে; পরিবারের ইতিহাসে রক্তের স্মৃতি আছে। কিন্তু এখন এই শব্দকে কেউ কেউ বাস্তবময় করে তুলছে, স্বাধীনতার পরিপন্থী কথা বলছে —এটা কষ্ট দেয়।” রাজশাহীর এক তরুণ বললেন, “আমি রাজনীতি বুঝি না, কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে কথা হলেই বলে ‘মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙ্গালিদের কে পথভ্রষ্ট করা’ তখন আমি রাজাকার বলি। গালি দিয়ে কি সমস্যার সমাধান হয়?” আবার সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখছেন, “যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের স্বার্থে বলছে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ দরকার; নরম থাকার সময় শেষ।” এই বিপরীতমুখী অনুভূতিগুলোই দেখায়—আমরা একই সঙ্গে স্মৃতির ভার, পরিচয়ের রাজনীতি এবং ডিজিটাল মব-সংস্কৃতির ত্রিমুখী চাপে আছি।

কোথায় দাঁড়াবে সাংবাদিকতা ও নাগরিকতা সাংবাদিকতার কাজ তথ্য যাচাই, প্রেক্ষাপট দেওয়া ও তর্ককে সভ্য রাখা। “রাজাকার সূচক” বলে যে-সব দাবির কথা ঘুরছে সেগুলো সত্য হতে বেশিদিন নেই। একইভাবে, টকশো বা সাক্ষাৎকারে “মুক্তিযুদ্ধ ভারতের স্বার্থে”—ধরনের প্ররোচনামূলক বক্তব্যকে প্রেক্ষাপটহীনভাবে সম্প্রচার করলে তা কেবল ক্লিকস বাড়ায়, সত্য।
নাগরিক হিসেবেও আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার—কেউ ‘স্বাধীনতাকে প্রহসন’ বললেই যেন আমরা তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল লিঞ্চিংয়ে ঝাঁপিয়ে পরি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিকৃত বক্তব্যকেও “অভিমত” বলে হাততালি না দিই।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে ইতিহাস বিকৃতির লাইসেন্স নয়। শেষ কথা ‘রাজাকার সূচক’ আমাদের সামনে দুইটি সত্য তুলে ধরে। আমাদের প্রয়োজন ঠান্ডা মাথার যাচাই, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা, এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুক্তির চেতনা এই অর্থে বিশ্বাস করি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *